শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫

গজওয়ায়ে উহুদ বা উহুদের যুদ্ধ

গজওয়ায়ে উহুদ বা উহুদের যুদ্ধ
═❖════❖════❖═
ইমরান বিন বদরী ≪ 
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম,আম্মা বা’দ।
উহুদের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘটনা।বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর মক্কার কাফির কুরাইশরা যখন মক্কায় পৌঁছলো এবং আবু সুফিয়ানও তার কাফিলা নিয়ে মক্কায় ফিরে এল, তখন যাদের পিতা,পুত্র কিংবা ভাই বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তাদের একটি দল আবু সুফিয়ানের কাছে গেল এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বলে।তখন আবু সুফিয়ানরা বললো, হে কুরাইশগণ, মুহাম্মদ তোমাদের বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এবার তোমাদের এই যাবতীয় সম্পদ দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য কর, তাহলে আশা করি আমরা আমাদের হারানো লোকদের উপয্ক্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবো। সবাই সম্মতি দিলে হিজরী তৃতীয় সনে শাওয়াল মাসে কুরাইশ মুশরিকরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে মদীনার দিকে অগ্রসর হয়। মদিনার তিন মাইল উত্তর-পূর্বে উহুদ পাহাড়। কুরাইশ বাহিনী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনী ফেলে। তাদের যোদ্ধার একটি বাহিনী উহুদের দিকে রওয়ানা হয় ফলে সেখানেই সংগঠিত হয়েছিল রক্তক্ষয়ী উহুদের যুদ্ধ।যুদ্ধের পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত লোক নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে সরে পড়লে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র সাত শত মুজাহিদ নিয়ে তিন হাজার যোদ্ধার সম্মুখীন হয়ে এই অসম যুদ্ধে মুসলিমরা বীর বিক্রমে লড়াই করেন। প্রথমে মুসলমানরা বিজয়ী হলেও পরবর্তীতে কৌশলগন স্হান ত্যাগ করার কারনে সাময়িক বিপর্যয় ঘটে। ফলে যুধ্ধটি অমিমাংশিত থেকে যায়। রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে হজরত হামজা রাদিআল্লাহু আনহু সহ এতে ৭০ জন বীর মুসলমান শহীদ হন এবং ৩৭ জন কাফের নিহত হয়।এ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ হজরত আবুবকর রাদিআল্লাহু আনহু ও হজরত উমর রাদিআল্লাহু আনহুও আহত হন। হজরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বর্শার আঘাতে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডান দিকের নিচের দাঁত ভেঙে যায় এবং তাঁর নীচের ঠোঁট আহত হয়।

═❖
উহুদের যুদ্ধের পর মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।
إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ وَتِلْكَ الأيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاء وَاللّهُ لاَ يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।
وَلِيُمَحِّصَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ
আর এ কারণে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধবংস করে দিতে চান।
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّهُ الَّذِينَ جَاهَدُواْ مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ
তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল। (আলে ইমরান : ১৩৯-১৪২)
এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ করায় শত্রুপক্ষ মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
সেদিন হজরত মুস’য়াব ইবনে উমাইর রাদিআল্লাহু আনহু, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষার জন্য বীরোচিতভাবে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। তাঁকে হত্যা করেছিলো ইবনে কিময়া লাইসী। সে মনে করেছিরো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই হত্যা করেছে। তাই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” মুসয়াব নিহত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলী ইবনে আবু তালিব রাদিআল্লাহু আনহুর হাতে পতাকা অর্পন করলেন অতঃপর আলী রাদিআল্লাহু আনহু ও অন্যান্য মুসলিম বীর শার্দুলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
উহুদের যুদ্ধ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের পতাকাতলে বসলেন। তিনি আলী রাদিআল্লাহু আনহু কে দূত মারফত নির্দেশ দিলেন যে,“পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও।
যুদ্ধে মুশরিক বাহিনী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কুরবানী করতে প্রস্তুত? এ কথা শুনে যিয়াদ ইবনে সাকান সহ পাঁচজন আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ ইবনে সাকান কিংবা আম্মারা ইবনে ইয়াযীদ ইবনুস সাকান। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতরভাবে আহত হলেন। ইতিমধ্যে মুসলমানদের একটি দল সেখানে ফিরে এলো এবং উক্ত আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন, “ওকে আমার কাছে আনো।” মুসলমানগণ তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলো। তিনি নিজের জানুর ওপর তার মাথা রেখে শোয়ালেন। এই অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী শহীদ হলেন।
আরেক বীর বিক্রম হজরত আবু দুজানা রাদিআল্লাহু আনহু নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর পিঠে তীর বিদ্ধ হচ্ছিলো আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে তাঁর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে তাঁর গায়ে বিদ্ধ তীরের সংখ্যা প্রচুর। আ সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিরক্ষার চেষ্টায় তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সা’দ বললেন, “আবু দুজানাকে দেখলাম, আমাকে একটার পর একটা তীর দিয়েই চলছেন আর বলছেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক। তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাক।’ এমনকি সময় সময় তিনি ফলকবিহীন তীরও দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘নিক্ষেপ কর।”
যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাত লাভের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন কা’ব ইবনে মালিক। কা’ব সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলেন “হে মুসলমানগণ, সুসংবাদ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে আছেন। তিনি এখানে।
এ দিনটি ছিলো মুসলমানদের জন্য এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা ও পরিশুদ্ধির দিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন