ইমামে আজম হযরত আবু হানীফা (রহ.) এর জীবনী
✍ ইমরান বিন বদরী ≪
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম আম্মা বা’দ।সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রব রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য;আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের নবী দোজাহানের সরদার বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
যুগে যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যেসব মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন,যারা অন্যায় ও অসত্যের কাছে কোনোদিন মাথানত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারা জীবন যারা পরিশ্রম করে গেছেন, সত্যকে অাঁকড়ে থাকার কারণে যারা নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের মধ্যে অন্যতম।ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ওয়াল ফুকাহা, হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক, কোটি মানুষের স্মরণীয়-বরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম আজম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেমনি ছিলেন সর্বসম্মত ফকীহ,তেমনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত মুহাদ্দিস। কুরআন সুন্নার দিক-নির্দেশনায় তাঁর অসামান্য অবদানের কথা মুসলিম উম্মাহ স্মরণ করবে অনন্তকাল পর্যন্ত। তাঁরআধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা ও কুরআন-সুন্নার গবেষণায় সুনিপূন কৃতিত্ব আদর্শ হয়ে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।
**✽পরিচয় ✽**
নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান (আরবি نعمان بن ثابت بن زوطا بن مرزبان)
৭০০সালে ৮০ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সাবিত বিন যুতা ছিলেন আফগানিস্তানের কাবুলে একজন সৎ আমানতদার ব্যবসায়ী।বাল্যকালেই তিনি পিতার থেকে ব্যবসা শিক্ষা করেছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি যুগের বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ এর দরসে উপস্থিত হতে থাকেন।
►একদা ইমাম শা’বী রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরসে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “তোমার ভিতরে আমি অপূর্ব মেধা ও বেনযীর প্রতিভার নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি।” ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তাঁর এ কথা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করলো। তখন থেকে আমি হাঁটে-বাজারে গমন ছেড়ে দিয়ে ইলমের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলাম। এরপর থেকে তিনি ইলম অন্বষণে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। বিশেষ করে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিক্হে গভীর মনোনিবেশ করেন। তিনি যখন হাদীস চর্চায় ব্রতী হন তখন সারা দুনিয়ায় ইলমে হাদীসের ব্যাপক চর্চা চলছিল, যে কারণে তিনি তখনকার সকল বড় বড় হাদীস বিশারদ ও ফকীহদের থেকে উপকৃত হতে পেরেছিলেন।তিনি ‘কূফা’ শহরেই ‘ইলমে ক্বালাম’ শিক্ষা করেন। অতঃপর কূফার শীর্ষস্থানীয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ‘হাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। অতঃপর ১২০ হিজরীতে ‘হযরত হাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির স্থলাভিষিক্ত হন এবং কুফার ‘মাদ্রাসাতুর রায়’ এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন।সেই সাথে ইরাকের অনন্য ইমাম বলে বিবেচিত হন এবং অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন। ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির শাইখ ও উস্তাদের সংখ্যা চার হাজারের মতো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম শা’বী, আ’মাশ, সিমাক ইবনে হারব, হাসান বসরী, শু’বা, কাতাদা, আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইকরামা ও হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ।তিনি হাদীস বর্ণনা এবং উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহ ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য ছিলেন।
►উপনাম ** ইমাম আবু হানিফা নামেই তিনি অত্যাধিক পরিচিত।
**✽এখানে একটি ঘটনা বলি যে,মুয়াফফাক আলমক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি(৫৬৪ হি.) ‘মানাকিবু আবী হানীফা’’ গ্রন্থে (খন্ড ২, পৃষ্ঠা : ১৫১-১৫২) আবু ইসমা সা’দ ইবনে মুয়ায রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি আবু সুলায়মান জুযাজানী থেকে, তিনি ইমাম মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে,আর তিনি ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেছেন।
►ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
كنا نكلم أبا حنيفة في باب من أبواب العلم، فإذا قال بقول واتفق عليه أصحابه درت على مشايخ الكوفة هل أجد في تقوية قوله حديثا أو أثرا؟ فربما وجدت الحديثين أو الثلاثة فآتيه بها، فمنها ما يقبله ومنها ما يرده، فيقول : هذا ليس بصحيح أوليس بمعروف، وهو موافق لقوله! فأقول له : وما علمك بذلك؟ فيقول : أنا عالم بعلم الكوفة.
‘আমরা আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে একটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতাম। এরপর যখন তিনি সিদ্ধান্ত দিতেন এবং তার সঙ্গীরাও একমত হতেন তখন আমি কুফার শায়েখগণের কাছে যেতাম তার সিদ্ধান্তের সমর্থনে আরো কোনো হাদীস বা আছর পাই কিনা। কখনো দুইটি বা তিনটি হাদীস পেতাম। তাঁর কাছে পেশ করার পর তিনি কোনোটি গ্রহণ করতেন আবার কোনোটি এই বলে বর্জন করতেন যে, এটি সহীহ নয় বা মারুফ নয়। অথচ তা তার সিদ্ধান্তের অনুকূলে। আমি বলতাম, এ সম্পর্কে আপনার ইলম কীরূপ। তিনি বলতেন, আমি কূফা নগরীর ইলমের ধারক।সত্যি তিনি ছিলেন কুফার মনীষীগণের কাছে সংরক্ষিত ইলমের ধারক।
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১২ লাখ ৯০ হাজার মাসআলা ইস্তিম্বাত করেছেন।
► হযরত আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ
ﺍﻟﻠَّﻪِ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – « ﺇِﺫَﺍ ﺣَﻜَﻢَ ﺍﻟْﺤَﺎﻛِﻢُ ﻓَﺎﺟْﺘَﻬَﺪَ ﻓَﺄَﺻَﺎﺏَ ﻓَﻠَﻪُ ﺃَﺟْﺮَﺍﻥِ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻜَﻢَ ﻓَﺎﺟْﺘَﻬَﺪَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-“যখন কোন বিশেষজ্ঞ হুকুম দেয়, আর তাতে সে ইজতিহাদ করে তারপর সেটা সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদ করে ভুল করে তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব।
{সহীহ বুখারী,৬৯১৯, সুনানে আবু দাউদ৩৫৭৬, সহীহ মুসলিম ৪৫৮৪}
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনিই সর্বপ্রথম ফিকহের তারতীবে ইলমে হাদীস সংকলন করেন এবং অমূল্য গ্রন্থ ‘কিতাবুল আছার’ লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অনুসরণে মুয়াত্তা কিতাব প্রণয়ন করেন।
✽ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন সাহাবায়ে-কেরামগণ আর সাহাবীদের পরবর্তী মর্তবা হচ্ছে তাবেয়ীগণের।ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাবেয়ী। তাঁর এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে মাত্র দুইজন বা তিনজন বর্ণনাকারী থাকতেন। এতে তাঁর বর্ণিত হাদীস সবচেয়ে সহীহ বলে বিবেচিত হত।
✽ ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেসব সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন।
এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) হযরত সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) হযরত আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী)
**✽একটি স্মরণীয় ঘটনা✽**
জনৈক ব্যক্তি একবার হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, হুজুর ! এক জায়াগায় আমি কিছু টাকা হিফাজতের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে জায়গার কথা স্মরন করতে পারছি না।
অথচ টাকার খুবই দরকার। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন,হে ব্যক্তি এটাতো কোন ফিক্বহী মাসায়ালা নয়।আমি কি সমাধান দিব ?
আগন্তক ব্যক্তি বড় অনুনয় বিনয় করে বলল, হুজুর ! একটা সমাধান বলে দিন। হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যাও ওযু করে সারা রাত নামাজ পড়তে থাক।
উক্ত ব্যক্তি বাড়ি গিয়ে ওযু করে নামাজ শুরু করে দিল। দু চার রাকাত পড়তে না পড়তেই টাকার কথা মনে পড়ে গেলো।সে দৌড়ে এসে সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে সংবাদ দিলো যে,হুজুর আপনার নছীহত মুবারক কাজে লেগেছে।হারানো টাকা পেয়ে গেছি। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হে ব্যক্তি !শয়তান কিভাবে এটা বরদাশত করবে যে, তুমি সারারাত নামাজ পড়তে থাক। তাই দু চার রাকায়াত পড়তে না পড়তেই মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে তোমার উচিত ছিলো শুকরিয়া স্বরূপ বাকি রাত নামাজের মধ্যে কাটানো।”
সুবহানাল্লাহ্ !!(তাযকিরাতুন নু’মান ৩৫৬ পৃষ্ঠা)।
**✽ ফিকহ ✽**
ফিকহ (আরবি ভাষায়: الفقه) একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো উপলব্ধি করা, গভীরভাবে কিছু বুঝতে পারা, অনুধাবন করা, সূক্ষ্মদর্শিতা ইত্যাদি।
►প্রখ্যাত অভিধান বিশারদ আল্লামা আবুল ফযল জামালুদ্দীন মুহাম্মদ আল মিসরী (রহ) বলেন,
العلم بالشيء والفهمُ له
“ফিকহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, কোন কিছু সম্বন্ধে জানা ও বুঝা।” [লিসানুল আরব]
ইসলামি আইনশাস্ত্র, যা অধ্যয়নের মাধমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের বিধান জানা যায়।
কুরআন ও হাদীসের মৌলিক বিধানগুলোর যে প্রায়োগিক রূপ হলো ফিকহ শাস্ত্র।সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ফিক্বহী মাসায়ালার ইমাম।
(একজন ফকীহ শয়তানের জন্য হাজার (মূর্খ) আবেদ অপেক্ষা ভয়ংকর” (তিরমিযি)।
**✽ মাযহাব ✽**
মাযহাব (আরবি: مذهب )ইসলামী ফিকহ বা ব্যবহারশাস্ত্রের অন্তর্ভূক্ত এক একটি চর্চাকেন্দ্র। মোট চারটি প্রধান মাজহাবকে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক সার্বিকভাবে গড় হিসাব অনুযায়ী পালনযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে| শরীয়তের বিষয়গুলোতে চার মযহাবকে অনুসরণ করার ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানদের মাঝে এজমা তথা ঐকমত্য হয়েছে।২০০৪ সালের ৯ই নভেম্বর জর্দানের আম্মানে অনুষ্ঠিত আম্মান বার্তা সম্মেলনে বিশ্বের ৫০ টি দেশের ২০০ জন মুসলিম আলেমের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত মাজহাবকে বর্তমান সময়ের জন্য পালনীয় হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়।
❶হানাফি (সুন্নি)
❷মালিকি (সুন্নি)ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামীদের মালিকি বলা হয়।
❸শাফিয়ি (সুন্নি)ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে এই মাজহাবের উদ্ভব হয়।
❹হাম্বলি (সুন্নি)এই মাযহাবপন্থীরা ইমাম ইবনে হানবল রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামী।
✽ হানফির পরিচয় ► হানফি (আরবি: الحنفي) হল সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে বড় মাযহাব। এই মতাবলম্বী মানুষেরা সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামী। মুলত ইমাম আবু হানীফার দুই ভক্ত ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ আল সায়বানীর অধীনে এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে।দুনিয়ার বহু মুসলিম দেশে এই মতবাদ প্রচলিত।
সুদান, মিশর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান, আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানে এই মতাবলম্বী মানুষ আছেন।ইমাম আবু হানিফার বাস ছিল ইরাকের বাগদাদ শহরে।মুলত সৌদি আরবের উত্তরে যে সব দেশে স্থলপথে ইসলাম প্রবেশ করেছিলসে সব দেশে এই মতবাদ প্রচলিত।ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি চার প্রসিদ্ধ ইমামের মাঝে বড় ইমাম হিসাবেই পরিচিত।
**✽ ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বিজ্ঞজনের উক্তি ✽**
►ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন,
ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফা রহ.-এর পরিবারভুক্ত।
(আছারুল ফিকহিল ইসলামী,পৃ:২২৩)
►আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
"ইমাম আবু হানীফা রহ.-র মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম,
শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রহ. গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন,
"আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো"।
(তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১,পৃ: ৪৫০)
►ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-
হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।
►ইমাম বোখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বলেন,
“আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন”(মানাক্বেবে ইমাম আজম রহ.1/95)
►ইমাম তিরমিযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বহু স্হলে কূফাবাসীদের অভিমতের উল্লেখ করেছেন। এই কুফা নগরীতেই ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্ম এবং এই শহরেই তিনি জ্ঞানার্জন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
►হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে এই মতামত ব্যক্ত করেন- কথিত আছে যে, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি আধা রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন। একদা তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁর দিকে ইঙ্গিত করে এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বলে যে, ইনি সেই ব্যক্তি যিনি সারা রাত আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। ঐ দিনের পর থেকে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সারা রাত জাগ্রত থাকতেন এবং বলতেন যে, আল্লাহর নিকট আমার এ বিষয়ে লজ্জা হয় যে, লোকে আমার এবাদত সম্পর্কে এ কথা বলে, যা আমার মধ্যে নেই।
**✽ ওফাত ✽**
৭৬৩ আব্বাসীয় বংশের খলিফা আল-মনসুর ইমাম আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার (খলিফার)
নিজস্ব কারণ ছিল, ইমাম আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর ইমাম আবু হানিফাকে গেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
১৫০ হিজরীতে ৭৬৭ সালে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৬৭ বছর বয়সে বাগদাদ শহরে কারাগারে খাদ্যের সঙ্গে বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন তাকে জেলখানর ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির জানাযায় অনেক অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল।
✼ বন্ধুরা-►
মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির ফিক্বহী মাসায়ালা থেকে আমাদের উপকৃত হওয়ার তওফীক দান করুন। আমীন।
(সবাইকে অনুরোধ করছি আমার এই লেখাটিতে ভুল হলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না প্লীজ,আপনার সঠিক মতামতে আমি উপকৃত হব)
✍ ইমরান বিন বদরী ≪
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম আম্মা বা’দ।সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রব রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য;আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের নবী দোজাহানের সরদার বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
যুগে যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যেসব মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন,যারা অন্যায় ও অসত্যের কাছে কোনোদিন মাথানত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারা জীবন যারা পরিশ্রম করে গেছেন, সত্যকে অাঁকড়ে থাকার কারণে যারা নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের মধ্যে অন্যতম।ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ওয়াল ফুকাহা, হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক, কোটি মানুষের স্মরণীয়-বরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম আজম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেমনি ছিলেন সর্বসম্মত ফকীহ,তেমনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত মুহাদ্দিস। কুরআন সুন্নার দিক-নির্দেশনায় তাঁর অসামান্য অবদানের কথা মুসলিম উম্মাহ স্মরণ করবে অনন্তকাল পর্যন্ত। তাঁরআধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা ও কুরআন-সুন্নার গবেষণায় সুনিপূন কৃতিত্ব আদর্শ হয়ে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।
**✽পরিচয় ✽**
নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান (আরবি نعمان بن ثابت بن زوطا بن مرزبان)
৭০০সালে ৮০ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সাবিত বিন যুতা ছিলেন আফগানিস্তানের কাবুলে একজন সৎ আমানতদার ব্যবসায়ী।বাল্যকালেই তিনি পিতার থেকে ব্যবসা শিক্ষা করেছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি যুগের বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ এর দরসে উপস্থিত হতে থাকেন।
►একদা ইমাম শা’বী রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরসে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “তোমার ভিতরে আমি অপূর্ব মেধা ও বেনযীর প্রতিভার নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি।” ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তাঁর এ কথা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করলো। তখন থেকে আমি হাঁটে-বাজারে গমন ছেড়ে দিয়ে ইলমের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলাম। এরপর থেকে তিনি ইলম অন্বষণে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। বিশেষ করে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিক্হে গভীর মনোনিবেশ করেন। তিনি যখন হাদীস চর্চায় ব্রতী হন তখন সারা দুনিয়ায় ইলমে হাদীসের ব্যাপক চর্চা চলছিল, যে কারণে তিনি তখনকার সকল বড় বড় হাদীস বিশারদ ও ফকীহদের থেকে উপকৃত হতে পেরেছিলেন।তিনি ‘কূফা’ শহরেই ‘ইলমে ক্বালাম’ শিক্ষা করেন। অতঃপর কূফার শীর্ষস্থানীয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ‘হাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। অতঃপর ১২০ হিজরীতে ‘হযরত হাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির স্থলাভিষিক্ত হন এবং কুফার ‘মাদ্রাসাতুর রায়’ এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন।সেই সাথে ইরাকের অনন্য ইমাম বলে বিবেচিত হন এবং অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন। ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির শাইখ ও উস্তাদের সংখ্যা চার হাজারের মতো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম শা’বী, আ’মাশ, সিমাক ইবনে হারব, হাসান বসরী, শু’বা, কাতাদা, আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইকরামা ও হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ।তিনি হাদীস বর্ণনা এবং উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহ ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য ছিলেন।
►উপনাম ** ইমাম আবু হানিফা নামেই তিনি অত্যাধিক পরিচিত।
**✽এখানে একটি ঘটনা বলি যে,মুয়াফফাক আলমক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি(৫৬৪ হি.) ‘মানাকিবু আবী হানীফা’’ গ্রন্থে (খন্ড ২, পৃষ্ঠা : ১৫১-১৫২) আবু ইসমা সা’দ ইবনে মুয়ায রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি আবু সুলায়মান জুযাজানী থেকে, তিনি ইমাম মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে,আর তিনি ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেছেন।
►ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
كنا نكلم أبا حنيفة في باب من أبواب العلم، فإذا قال بقول واتفق عليه أصحابه درت على مشايخ الكوفة هل أجد في تقوية قوله حديثا أو أثرا؟ فربما وجدت الحديثين أو الثلاثة فآتيه بها، فمنها ما يقبله ومنها ما يرده، فيقول : هذا ليس بصحيح أوليس بمعروف، وهو موافق لقوله! فأقول له : وما علمك بذلك؟ فيقول : أنا عالم بعلم الكوفة.
‘আমরা আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে একটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতাম। এরপর যখন তিনি সিদ্ধান্ত দিতেন এবং তার সঙ্গীরাও একমত হতেন তখন আমি কুফার শায়েখগণের কাছে যেতাম তার সিদ্ধান্তের সমর্থনে আরো কোনো হাদীস বা আছর পাই কিনা। কখনো দুইটি বা তিনটি হাদীস পেতাম। তাঁর কাছে পেশ করার পর তিনি কোনোটি গ্রহণ করতেন আবার কোনোটি এই বলে বর্জন করতেন যে, এটি সহীহ নয় বা মারুফ নয়। অথচ তা তার সিদ্ধান্তের অনুকূলে। আমি বলতাম, এ সম্পর্কে আপনার ইলম কীরূপ। তিনি বলতেন, আমি কূফা নগরীর ইলমের ধারক।সত্যি তিনি ছিলেন কুফার মনীষীগণের কাছে সংরক্ষিত ইলমের ধারক।
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১২ লাখ ৯০ হাজার মাসআলা ইস্তিম্বাত করেছেন।
► হযরত আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ
ﺍﻟﻠَّﻪِ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – « ﺇِﺫَﺍ ﺣَﻜَﻢَ ﺍﻟْﺤَﺎﻛِﻢُ ﻓَﺎﺟْﺘَﻬَﺪَ ﻓَﺄَﺻَﺎﺏَ ﻓَﻠَﻪُ ﺃَﺟْﺮَﺍﻥِ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻜَﻢَ ﻓَﺎﺟْﺘَﻬَﺪَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-“যখন কোন বিশেষজ্ঞ হুকুম দেয়, আর তাতে সে ইজতিহাদ করে তারপর সেটা সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদ করে ভুল করে তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব।
{সহীহ বুখারী,৬৯১৯, সুনানে আবু দাউদ৩৫৭৬, সহীহ মুসলিম ৪৫৮৪}
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনিই সর্বপ্রথম ফিকহের তারতীবে ইলমে হাদীস সংকলন করেন এবং অমূল্য গ্রন্থ ‘কিতাবুল আছার’ লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অনুসরণে মুয়াত্তা কিতাব প্রণয়ন করেন।
✽ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন সাহাবায়ে-কেরামগণ আর সাহাবীদের পরবর্তী মর্তবা হচ্ছে তাবেয়ীগণের।ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাবেয়ী। তাঁর এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে মাত্র দুইজন বা তিনজন বর্ণনাকারী থাকতেন। এতে তাঁর বর্ণিত হাদীস সবচেয়ে সহীহ বলে বিবেচিত হত।
✽ ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেসব সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন।
এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) হযরত সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) হযরত আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী)
**✽একটি স্মরণীয় ঘটনা✽**
জনৈক ব্যক্তি একবার হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, হুজুর ! এক জায়াগায় আমি কিছু টাকা হিফাজতের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে জায়গার কথা স্মরন করতে পারছি না।
অথচ টাকার খুবই দরকার। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন,হে ব্যক্তি এটাতো কোন ফিক্বহী মাসায়ালা নয়।আমি কি সমাধান দিব ?
আগন্তক ব্যক্তি বড় অনুনয় বিনয় করে বলল, হুজুর ! একটা সমাধান বলে দিন। হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যাও ওযু করে সারা রাত নামাজ পড়তে থাক।
উক্ত ব্যক্তি বাড়ি গিয়ে ওযু করে নামাজ শুরু করে দিল। দু চার রাকাত পড়তে না পড়তেই টাকার কথা মনে পড়ে গেলো।সে দৌড়ে এসে সাইয়্যিদুনা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে সংবাদ দিলো যে,হুজুর আপনার নছীহত মুবারক কাজে লেগেছে।হারানো টাকা পেয়ে গেছি। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হে ব্যক্তি !শয়তান কিভাবে এটা বরদাশত করবে যে, তুমি সারারাত নামাজ পড়তে থাক। তাই দু চার রাকায়াত পড়তে না পড়তেই মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে তোমার উচিত ছিলো শুকরিয়া স্বরূপ বাকি রাত নামাজের মধ্যে কাটানো।”
সুবহানাল্লাহ্ !!(তাযকিরাতুন নু’মান ৩৫৬ পৃষ্ঠা)।
**✽ ফিকহ ✽**
ফিকহ (আরবি ভাষায়: الفقه) একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো উপলব্ধি করা, গভীরভাবে কিছু বুঝতে পারা, অনুধাবন করা, সূক্ষ্মদর্শিতা ইত্যাদি।
►প্রখ্যাত অভিধান বিশারদ আল্লামা আবুল ফযল জামালুদ্দীন মুহাম্মদ আল মিসরী (রহ) বলেন,
العلم بالشيء والفهمُ له
“ফিকহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, কোন কিছু সম্বন্ধে জানা ও বুঝা।” [লিসানুল আরব]
ইসলামি আইনশাস্ত্র, যা অধ্যয়নের মাধমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের বিধান জানা যায়।
কুরআন ও হাদীসের মৌলিক বিধানগুলোর যে প্রায়োগিক রূপ হলো ফিকহ শাস্ত্র।সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ফিক্বহী মাসায়ালার ইমাম।
(একজন ফকীহ শয়তানের জন্য হাজার (মূর্খ) আবেদ অপেক্ষা ভয়ংকর” (তিরমিযি)।
**✽ মাযহাব ✽**
মাযহাব (আরবি: مذهب )ইসলামী ফিকহ বা ব্যবহারশাস্ত্রের অন্তর্ভূক্ত এক একটি চর্চাকেন্দ্র। মোট চারটি প্রধান মাজহাবকে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক সার্বিকভাবে গড় হিসাব অনুযায়ী পালনযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে| শরীয়তের বিষয়গুলোতে চার মযহাবকে অনুসরণ করার ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানদের মাঝে এজমা তথা ঐকমত্য হয়েছে।২০০৪ সালের ৯ই নভেম্বর জর্দানের আম্মানে অনুষ্ঠিত আম্মান বার্তা সম্মেলনে বিশ্বের ৫০ টি দেশের ২০০ জন মুসলিম আলেমের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত মাজহাবকে বর্তমান সময়ের জন্য পালনীয় হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়।
❶হানাফি (সুন্নি)
❷মালিকি (সুন্নি)ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামীদের মালিকি বলা হয়।
❸শাফিয়ি (সুন্নি)ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে এই মাজহাবের উদ্ভব হয়।
❹হাম্বলি (সুন্নি)এই মাযহাবপন্থীরা ইমাম ইবনে হানবল রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামী।
✽ হানফির পরিচয় ► হানফি (আরবি: الحنفي) হল সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে বড় মাযহাব। এই মতাবলম্বী মানুষেরা সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুগামী। মুলত ইমাম আবু হানীফার দুই ভক্ত ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ আল সায়বানীর অধীনে এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে।দুনিয়ার বহু মুসলিম দেশে এই মতবাদ প্রচলিত।
সুদান, মিশর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান, আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানে এই মতাবলম্বী মানুষ আছেন।ইমাম আবু হানিফার বাস ছিল ইরাকের বাগদাদ শহরে।মুলত সৌদি আরবের উত্তরে যে সব দেশে স্থলপথে ইসলাম প্রবেশ করেছিলসে সব দেশে এই মতবাদ প্রচলিত।ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি চার প্রসিদ্ধ ইমামের মাঝে বড় ইমাম হিসাবেই পরিচিত।
**✽ ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বিজ্ঞজনের উক্তি ✽**
►ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন,
ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফা রহ.-এর পরিবারভুক্ত।
(আছারুল ফিকহিল ইসলামী,পৃ:২২৩)
►আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
"ইমাম আবু হানীফা রহ.-র মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম,
শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রহ. গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন,
"আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো"।
(তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১,পৃ: ৪৫০)
►ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-
হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।
►ইমাম বোখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বলেন,
“আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন”(মানাক্বেবে ইমাম আজম রহ.1/95)
►ইমাম তিরমিযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বহু স্হলে কূফাবাসীদের অভিমতের উল্লেখ করেছেন। এই কুফা নগরীতেই ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্ম এবং এই শহরেই তিনি জ্ঞানার্জন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
►হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে এই মতামত ব্যক্ত করেন- কথিত আছে যে, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি আধা রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন। একদা তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁর দিকে ইঙ্গিত করে এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বলে যে, ইনি সেই ব্যক্তি যিনি সারা রাত আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। ঐ দিনের পর থেকে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সারা রাত জাগ্রত থাকতেন এবং বলতেন যে, আল্লাহর নিকট আমার এ বিষয়ে লজ্জা হয় যে, লোকে আমার এবাদত সম্পর্কে এ কথা বলে, যা আমার মধ্যে নেই।
**✽ ওফাত ✽**
৭৬৩ আব্বাসীয় বংশের খলিফা আল-মনসুর ইমাম আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার (খলিফার)
নিজস্ব কারণ ছিল, ইমাম আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর ইমাম আবু হানিফাকে গেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
১৫০ হিজরীতে ৭৬৭ সালে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৬৭ বছর বয়সে বাগদাদ শহরে কারাগারে খাদ্যের সঙ্গে বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন তাকে জেলখানর ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির জানাযায় অনেক অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল।
✼ বন্ধুরা-►
মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির ফিক্বহী মাসায়ালা থেকে আমাদের উপকৃত হওয়ার তওফীক দান করুন। আমীন।
(সবাইকে অনুরোধ করছি আমার এই লেখাটিতে ভুল হলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না প্লীজ,আপনার সঠিক মতামতে আমি উপকৃত হব)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন