মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০১৫

লাইলাতুল ক্বদর

═◉ মহিমান্বিত রজনী বা লাইলাতুল ক্বদর ◉═

ইমরান বিন বদরী ≪ 
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম,আম্মা বা’দ।
সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের নবী সায়্যাদুল মুরসালীন প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।

═➲
ফিরে আসা সেই মহান রাত
যে রাত পবিত্র কুরআন নাজিলের রাত,যে রাত গুনাহ মাফের রাত,যে রাত দুয়া কবুল করার রাত,যে রাত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের রাত। যে রাত প্রতি বছর আসে পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত মানব জাতিকে সীমাহীন রহমতের ছায়ায় চির শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিতে। যে রাত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমত ও বরকতের প্লাবনের রাত। যে রাত মাগফিরাতের রাত। যা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য মহান আল্লাহর রমতের উপহারের রজনী যাকে লাইলাতুল ক্দর বলা হয়।
لیلة ‘লাইলাতুন’ আরবি শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আরالقدر ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ হলো সম্মান, মর্যাদা, মহিমান্বিত।সুতরাংلیلة القدر অর্থ মহিমান্বিত রজনী বা পবিত্র রজনী।ফার্সিতে শবে ক্বদর বলা হয়।এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ন কুরআন কারীমকে লাউহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে নাযিল করেন। তাছাড়া অন্য আরেকটি মত আছে যে,লাইলাতুল কদর রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত সায়্যাদুল মুরসালীন প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সর্বপ্রথম নাজিল হয়।অনেকের মতে এ রাতে ফেরেশতা জীবরাইল এর নিকট সম্পূর্ন কোরআন অবতীর্ন হয় যা পরবর্তিতে ২৩ বছর ধরে ইসলামের নবী মুহাম্মদের নিকট তার বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে নাজিল করা হয়।এ রাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
বন্ধুরা ➲ পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে অর্থাৎ
২১.২৩.২৫.২৭. ২৯ তারিখের একটি রাত,যে রাতের ইবাদত ৮৩.৩ বছরের ইবাদাতের সমান। একটা মানুষ যদি জীবনে সঠিকভাবে এমন একটি রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে রাজী করাতে পারে তবে জীবনের প্রায় সবটুকু সময় ইবাদতের মাজেই সে পার করলো।

◉ হযরত আব্দুল্লাহ বিন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমাযানের ২৭ শে রজনীতে অনুসন্ধান করে। (আহমাদ)

◉ হযরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি,আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমাযানের ২৭ তম রাত।(মুসলিম২৩৬৪)

◉ ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা (র:)২৭ তারিখের রাতকে অর্থাৎ ২৬ তারিখ দিবাগত রাতকে পবিত্র ক্বদর রজনী হিসেবে অধিক সম্ভাব্য বলেছেন।উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহ পদত্ত এটা অনেক বড় নিয়ামত। যে নিয়ামত আজ আমাদের হাতচানি দিচ্ছেন। সল্প এ জীবনে আগামী বছর এ রাত পাব কিনা তা কেবল আল্লাহ পাকেই ভালো জানেন।

◉ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে করিমের সূরা ক্বদর এ বলেন -
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ লাইলাতুল কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? ( আয়াত ২)
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (আয়াত ৩)

◉ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে--
عن عائشة عليها السلام قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تحروا ليلة القدر فى الوتر من العشر الاواخر من رمضان. অর্থ:উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-এর শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করো। (মুত্তাফাকুন আলাই)

◉ হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মধ্যম দশকে ইতিকাফ করতেন। এক বছর এরূপ ইতিকাফ করেন, যখন একুশের রাত এল, যে রাতের সকালে তিনি তাঁর ইতিকাফ হতে বের হবেন, তিনি বললেনঃ যারা আমার সংগে ইতিকাফ করেছে তারা যেন শেষ দশক ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এই রাত (লাইলাতুল কদর)দেখানো হয়েছিল। পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ)ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ঐ রাতের সকালে আমি কাদা-পানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এই রাতে আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হল , মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কপালে কাদা- পানির চিহ্ন আমার দু’চোখ দেখতে পায়। (মুত্তাফাকুন আলাই)

◉ হযরত মুহাম্মাদ ইবনুল মূসান্না (রহঃ) উকবা ইবনু হুরায়স (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বলতে শুনেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশদিনে কদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দূর্বল অথবা অপারগ হয়ে পরে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।(সহীহ মুসলিম ইফাঃ ২৬৩৬)

◉ হজরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত,রসুলুল্লাহ صلی اللہ علیہ و آلہ و سلم বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি লাইলাতুল ক্বাদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে। আর যে ব্যাক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে,তাঁরও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে। (সহীহ বুখারি)

◉ উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমযানের শেষ দশ দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন। (সহীহ মুসলিম শরীফ)

◉ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন:- ادعونى استجبلكم
অর্থ: “তোমরা আমার নিকট দুয়া করো আমি তোমাদের দুয়া কবুল করবো।”এ রাত্রিতে আল্লাহ পাক বান্দার দুয়া কবুল করে থাকেন।


------------------------
═➲ লাইলাতুল কদর রাতের কিছু আলামত❖
হাদীস শরীফ এ লাইলাতুল কদর রাতের কিছু আলামত বর্ণিত আছে। সেগুলো হল :
(১) রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। (২) নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না। (৩) মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে। (৪) সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে। (৫) কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন। (৬) ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে। (৭) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।(সহীহ বুখারী২০২১,মুসলিম৭৬২)
-------------------------
═➲ লাইলাতুল কদরের বিশেষ দুয়া❖
◉ উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা লাইলাতুল ক্বদর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী করব? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মত দেন, তুমি বলবে,“اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي”
উচ্চারণ: ‘‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন তুহিব্বুল আ’ফওয়া,ফা’ফু আন্নী।’হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।
(তিরমিযি,ইবনে মাজাহ ২/১২৬৫)

আসুন═➲ আমাদের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে এ রাতের ইবাদতে ব্রতী হওয়া জরুরি। লাইলাতুল ক্বদর-এ অনেক আমলই করা যায়। তা হলো--নামায পড়া।কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা।ছলাতুত তাসবীহ পড়া। দুরূদ শরীফ পাঠ করা।যিকির-আযকার করা।তাহাজ্জুদের নামায পড়া। দুয়া করা। বেশি বেশি কান্নাকাটি করা।তওবা ইস্তিগফার করা।সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ শেষে দুয়া করা। কেননা সিজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের সবচেয়ে নিকটে চলে যায়। হে আল্লাহ ! আমাদের সবাইকে রমজান মাসের এ রাতে ইবাদতে ব্রতী হওয়ার তৌফিক দান কর। আমীন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন