মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০১৫

ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি

হযরত ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি


(আমীরুল মু’ মিনীন ফীল হাদিস)
❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖ ✍ ইমরান বিন বদরী ≪
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম আম্মা বা’দ।
সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রব রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের নবী দোজাহানের সরদার বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
হাদিস সংকলনে যার অবদানের কথা মুসলিম জাতি কিয়ামত পর্যনত মনে রাখবেন ,ইসলামী ইতিহাসে যার নাম সবার আগে বলতে হয় এবং ইলমে হাদীসের জ্ঞানের গভীরতা,স্মৃতির প্রখরতা, চিন্তার বিশালতা,অটুট সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের একটি বিস্ময়ের নাম সেই বিখ্যাত বুখারী শরীফের লেখক হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

**পরিচয়**
মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইবব্রাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ (محمد بن اسماعيل بن ابراهيم بن مغيره بن بردزبه بخاری) 
বাবার নাম ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম।তাঁর বাবা ইসমাইল মুসলিম বিশ্বে একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হাদীসবিদ এবং হযরত ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর শাগরিদ। ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের বুখারাতে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ)জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে জন্ম গ্রহণ করেন।ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মাতাও ছিলেন মহীয়সী নেককার মহিলা।এ সম্পর্কে একটা ঘটনা আছে যে বাল্যকালে ✔ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ রোগের প্রভাবে তাঁর দুই চোখ প্রায় অন্ধই হয়ে যায়। স্নেহময়ই মাতা পুত্রের চোখের আলোর পুনঃপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ্‌ পাকের দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এক রাত্রে স্বপ্নে তিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে তার শিয়রে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বলেন, তোমার প্রার্থনা আল্লাহ্‌ পাক কবুল করেছেন। তাঁর দয়ার বরকতে তোমার পুত্র চোখের আলো ফিরে পেয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে তাঁর পুত্র ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলে ওটলেন, আম্মা! আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ ভাল হয়ে গেছে। এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে ইমাম বুখারী (রহঃ) এর মাতা কত বড় মাপের বুজুর্গ মহিলা ছিলেন।ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শৈশবেই বাবাকে হারান, ফলে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন।ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মহৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। দান-খয়রাত করা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পিতার বিরাট ধন-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর সবই গরীব দুঃখী ও হাদীস শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। 

তাঁর ❀ কুনিয়াতঃ আবূ আবদুল্লাহ। ❀ তাঁর উপাধি ছিলেন:-আমীরুল মু’ মিনীন ফীল হাদিস।

***❀ শিক্ষা ❀ ***
হযরত ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রথমে কোরআন পাঠ শুরু করেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্ত করেন।১০বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্ত করা শুরু করেন।১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন।১৮বছর বয়সে তিনি মা এবং বড় ভাই আহম্মদের সাথে হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন।এরপর হাদীস অন্বেষণের জন্য তিনি ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ বহু অঞ্চলে সফর করেন। একদা ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বসরার মুহাদ্দিস দাখেলি রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরসগাহে যোগ দেন। ইমাম দাখেলি রহমাতুল্লাহি আলাইহি একটি হাদিসের সনদ বর্ণনা করবার সময় 'জুবাইর' এর স্থলে 'আবু জুবাইর' বলেছেন। ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি নম্রস্বরে বললেন- এখানে আবু জুবাইর' এর স্থলে 'জুবাইর' হবে। অতঃপর ইমাম দাখেলি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বাড়িতে গিয়ে কিতাব দেখে তাঁর ভুল সংশোধন করেছেন। এর অব্যবহিত পরই দাখেলি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি এতদ্ভিন্ন অন্য এক দরসগাহে ও যোগ দিতেন। সেখানে অন্য ছাত্রগন হাদিসগুলো লিখে নিতেন। তিনি তা লিখতেন না। তাঁর সহঃপাঠিগণ তাঁকে হাদিস না লিখে রাখার কারন জিজ্ঞেস করলে কোন ওতর দেননি। অতঃপর সহঃপাঠিগণ তাঁকে হাদিস লেখার জন্য জোর তাগিদ দিলে ও ওতর দিলেন- "আপনাদের লেখা কপিগুলো নিয়ে আসুন। তারা কপিগুলো নিয়ে আসলে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাদের সামনে হাদিসগুলো পাঠ করে শোনান। সেই মজলিসে তাদের লেখা অনুসারে প্রায় পনের হাজার (১৫,০০০) হাদিস মুখস্থ পাঠ করে শোনান। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন।দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি হাদীস অন্বষণের ভ্রমণ শেষ করে নিজ মাতৃভূমি বুখারায় ফিরে আসেন।

**❀ বুখারী শরীফ সংকলন ❀ **
হযরত ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম হচ্ছে এই হাদীসগ্রন্থের রচনা। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াইহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন।বুখারী শরীফের পূর্ণ নাম ''আল জামিউল মুসনাদুস সহীহুল মুখতাসারু মিন উমূরি রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আয়্যামিহী''।
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আমি আমার সহিহ বুখারি সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়ের কাজ শেষ করি, একইভাবে মসজিদে নববীতে বসেও তিনি সহিহ বুখারি প্রণয়ের কাজ করেন। আর প্রতি বছরই হজ্ব পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি।তিনি ৬ লাখ হাদিস হতে যাচাই বাছাই করে সর্বসাকুলে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিধ্য গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। এখানে মোট হাদিস আছে সাত হাজার একশত পচাতর খানি(৭,১৭৫)।যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক-একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন।সকল মুহাদ্দিসের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, সমস্ত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে এবং কুরআন মজীদের পরেই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ গ্রন্থ।
**✔সহীহ আলবুখারী ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে রয়েছেঃ
১) আল আদাবুল মুফরাদ। ২) তারীখুল কাবীর।৩) তারীখুস সাগীর।
৪) খালকু আফআলিল ইবাদ।৫) রাফউল ইয়াদাইন ফিস্ সালাত।৬) জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম।
৭) কিতাবুয যুআ-ফাউস সাগীর।৮) কিতাবুল কুনা ৯) আত্ তাওয়ারীখ ওয়াল আনসাব
১০) কিতাবুত তাওহীদ১১) আখবারুস সিফাত।

** ✔মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারীর একটি স্মরণীয় ঘটনা ✔**
তিনি একবার একটি থলের ভিতর একহাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে হাদীছ অন্বেষণের সফরে বের হলেন। সফর অবস্থায় কোন এক চোর এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখে ফেলে এবং তা চুরি করার জন্য ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির পিছনে লাগে। কিন্তু চোর তা চুরি করার সকল প্রকার চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়। পথিমধ্যে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি পানি পথে ভ্রমণের জন্য জাহাজে আরোহন করলে চোরও তাঁর সাথে যাত্রা শুরু করে। সেখানেও সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরিশেষে চোর মুদ্রাগুলো চুরি করার নতুন এক কৌশল অবলম্বন করে। সে এই বলে চিৎকার করতে থাকে যে, এই জাহাজে উঠার পর আমার একহাজার স্বর্ণমুদ্রা চুরি হয়ে গেছে। মুদ্রাগুলো একটি থলের ভিতর ছিল। সে থলেটির ধরণও বর্ণনা করল, যা সে ইতিপূর্বে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে দেখেছিল। চিৎকার ও কান্নাকাটির মাধ্যমে চোরটি জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। মাঝি-মাল্লাগণ এক এক করে সকল যাত্রীর পকেট ও শরীর চেক করা শুরু করল। এই দৃশ্য দেখে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি চিন্তা ও হতাশায় পড়ে গেলেন। চোরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তিনি ভাবলেন এখন যদি আমাকে তল্লাশি করা হয় তাহলে তো আমার কাছে একহাজার স্বর্ণমুদ্র পাওয়া যাবে আর আমিই চোর হিসাবে সাব্যস্ত হবো। আমি অভিযোগ অস্বীকার করলেও আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না। আর আমি যদি আজ চোর হিসেবে ধরা পড়ি তাহলে সারা দুনিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়বে যে, মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা চুরি করেছে। আমার সারা জীবনের সাধনা ব্যর্থ হবে। আমি যে সমস্ত সহীহ হাদীছ সংগ্রহ করেছি, তাও লোকেরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং পবিত্র ইলমে হাদীছের অবমাননা হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার মায়া ত্যাগ করে রাসূলের হাদীছে মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার সিদ্বান্ত গ্রহণ করলেন। তাই তল্লাশ কারীগণ তাঁর শরীরে তল্লাশি চালানোর আগেই অতি গোপনে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ থলেটি পানিতে ফেলে দিলেন। এরপর সকলের মাল-পত্র ও শরীর তল্লাশির এক পর্যায়ে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির শরীরও তল্লাশি করা হলো। জাহাজের কারও কাছে কোন থলের ভিতর এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল না।
পরিশেষে জাহাজের লোকেরা চোরকেই মিথ্যাবাদী হিসেবে সাব্যস্ত করে সকলকে হয়রানি করার শাস্তি প্রদান করলো এবং আল্লাহ্ তাআলা তাকেই অপদস্ত করলেন। পরে চোর তাঁর সাথে একান্তে মিলিত হয়ে বললঃ জনাব আপনার সাথের এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা আপনি কোথায় রেখেছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ তোমার চক্রান্ত বুঝতে পেরে আমি তা পানিতে ফেলে দিয়েছি।

**ওফাত**
জীবনের শেষদিকে একবার বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা "খালিদ বিন আহমাদ যুহলী" হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বুখারীর পান্ডিত্য দেখে তাকে দরবারে এসে শাসনকর্তার সন্তানদেরকে হাদীস শেখাতে বলেন। হযরত ইমাম বুখারী এটাকে হাদীসের জন্য অবমাননাকর মনে করেন। ফলে উভয়ের মাঝে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। তখন তিনি মাতৃভূমি বুখারা ত্যাগ করে সমরকন্দের খরতঙ্গে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২৫৬ হিজরীর, ১লা শাওয়াল মোতাবেক ৩১শে আগস্ট, ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন শনিবার যোহরের নামাজের পর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাফন করার পর তাঁর কবর থেকে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। উজবেকিস্তানের, সমরকন্দ কাছাকাছি অবস্থিত ইমাম মুহাম্মদ আল-বুখারীর মাজার শরীফ।
✔বন্ধুরা--
মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ থেকে আমাদের উপকৃত হওয়ার তওফীক দান করুন। আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন