মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কুরবানী

কুরবানী
══❖══ ✏ ইমরান বিন বদরী ≪
اَلْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعاَلَمِيْنَ والصَّلوةُ و السَّلاَمُ عَلى اَشْرَفِ الْاَنْبِياءِ وَالْمُرْسَلِيْنَ وَعَلى اَلِه وَاَصْحَابِه اَجْمَعِيْنَ
ঈদুল আজহা (عيد الأضحى) ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদুল আযহা মূলত আরবী বাক্যাংশ।এর অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব কিংবা ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা সাধ্যমত ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী উট, গরু, দুম্বা কিংবা ছাগল কোরবানি বা জবাই দেয় পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে।
কুরবানী শব্দটি আরবী কুরবান শব্দ থেকে উদ্ভুত। কুরবানী শব্দের অর্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় জিলহজ্ব চাঁদের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট জন্তুকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জবেহ করে উৎসর্গ করার নাম কুরবানী। এটি ইসলাম ধর্মের অতি মূল্যবান ইবাদত।

ঐতিহাসিক পটভূমি:
-----------------------
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে অনেক পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি ধৈর্য্য ও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহপাক তাকে ইঙ্গিত করেছেন তার সবচাইতে প্রিয় জিনিসটিকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানী করতে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) অনেক ভেবেচিন্তে দেখলেন একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আ:) এর চেয়ে তার কাছে প্রিয় আর কোনো কিছু নেই। এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও সে পুত্র ইসমাঈল (আ:) কে বেশি ভালোবাসতেন। তারপরও তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অত:পর পুত্র ইসমাঈল (আ:) কে তিনি তার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি?” সে (হযরত ইসমাঈল (আঃ)) বলল, “হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন” (সূরা সফফাত আয়াত-১০২)। 
‪#‎কুরবানীর‬ অনুমোদনের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন।
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।(সূরা হাজ্জ, আয়াত নং-৩৪) 
‪#‎আল্লাহ‬ তা’আলা আরো বলেন। فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ 
অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর । (সূরা কাউসার : ২)
‪#‎তিনি‬ আরো বলেন :وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ 
আর কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি। (সূরা হজ :৩৬)
কুরবানীর তাৎপর্য:
----------------------
ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। প্রচলিত কুরবানী মূলতঃ হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর অপূর্ব আত্ম-ত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিচারণ। যেই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালবাসা ও ঐকান্তিকতা নিয়ে কুরবানী করেছিলেন ইব্রাহীম (আঃ), সেই আবেগ, অনুভূতি ও ঐকান্তিকতার অবিস্মরণীয় ঘটনাকে জীবন্ত রাখার জন্যই মহান আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মদীর উপর কুরবানী ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাই কুরবানী কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
#আল্লাহ পাক আরো বলেন, لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ
আল্লাহর নিকট (কুরবানীর পশুর) গোশত, রক্ত পৌঁছে না; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।
(সূরা হাজ্জ, আয়াত নং-৩৭)
কুরবানী মহান একটি ইবাদাত। কোরবানি বলা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তার এবাদতের জন্য পশু জবেহ করা।
‪#‎হজরত‬ আনাস ইবনু মালিক রাদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনা করেছেন।
أن النبي - صلى الله عليه وسلم - ضحى بكبشين أملحين أقرنين ذبحهما بيده وسمى وكبر.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরতাজা ও শিং ওয়ালা দুটি মেষ নিজ হাতে যবেহ করেছেন এবং তিনি তাতে বিসমিল্লাহ ও তাকবীর বলেছেন।(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
#হজরত জুনদুব ইবনু সুফিয়ান বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি কুরবানীর দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে উপস্হিত ছিলাম। তিনি বললেনঃ যে ব্যাক্তি সালাত আদায়ের পুর্বে যবাহ করেছে সে যেন এর স্থলে আবার যবাহ করে। আর যে যবাহ করেনি, সে যেন যবাহ করে নেয়।(সহিহ বুখারী)
#হজরত আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত।তিনি বলেন, মদিনায় অবস্থানের সময় আমরা কুররানীর গোশতের মধ্যে লবন মিশ্রিত করে রেখে দিতাম। এরপর তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে পেশ করতাম। তিনি বলতেনঃ তোমরা তিন দিনের পর খাবে না। তবে এটি জরুরী নয়। বরং তিনি চেয়েছেন যে,তা থেকে যেন অন্যদের খাওয়ান হয়। আল্লাহ অধিক জ্ঞাত। (সহিহ বুখারী)
কুরবানীর হুকুম:
---------------------
ইমাম আবু হানীফা রহ.ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ.মতে কোরবানি ওয়াজিব। যারা কোরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে মানব সকল ! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কোরবানি দেয়া। জ্ঞান সম্পন্ন, প্রাপ্ত বয়স্ক, নিসাব পরিমাণ মালিকের উপর শুধু একটি কুরবানীই ওয়াজিব হবে,অবশ্য কেউ যদি একাধিক কুরবানী করে তা নফল হিসেবে সওয়াবের অধিকারী হবে। ভাগে কুরবানী জায়েয।
#হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,একটি গরু সাতজনের পক্ষ কুরবানী করা যাবে। (তিরমিযী)
#হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِىْ سَفَرٍ فَحَضَرَ الْأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِى الْبَقَرَةِ سَبْعَةٌ وَ فِى الْبَعِيْرِ عَشَرَةٌ
‘আমরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল।তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হ’লাম’(তিরমিযী, নাসাঈ,ইবনু মাজাহ)
কুরবানীর ফজিলত:
------------------------
(ক) কোরবানি দাতা নবী ইবরাহিম (আ:)ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।
(খ) পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানি দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। 
(গ) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান।
#হজরত আয়শা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোন আমল আল্লাহর কাছে নাই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর,পশম সমূহ ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কুরবানীর রক্ত জমিনে পতিত হবার পুর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌছে যায়। অতএব, তোমরা কুরবানির দ্বারা নিজেদের নফস কে পবিত্র কর।
কুরবানীর পশু:
------------------
এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া,দুম্বা। এ গুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আনআম।’কুরবানীর পশু ভাল এবং হৃষ্টপুষ্ট হওয়াই উত্তম। শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু'বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। যদি ছয় মাসের দুম্বা বা ভেড়া এরূপ মোটা-তাজা হয় যে,দেখতে এক বছরের মত মনে হয় তাহলে এর দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে।
কোরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্র“টি মুক্ত হতে হবে অন্ধ ;যার অন্ধত্ব স্পষ্ট,রোগাক্রান্ত ; যার রোগ স্পষ্ট,পঙ্গু ;যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত;যার কোন অংগ ভেংগে গেছে ইত্যাদি। যে পশুটি কোরবানি করা হবে তার উপর কোরবানি দাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব থাকতে হবে।
কুরবানীর করার নিয়মাবলি:
---------------------------------- 
#হজরত মা আয়শা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন.অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লেন,
بِسْمِ اللهِ أَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُّحَمَّدٍ وَّ آلِ مُحَمَّدٍ وَّ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ رواه مسلم-
‘আল্লাহ্র নামে (কুরবানী করছি),হে আল্লাহ! তুমি এটি কবুল কর মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে,তার পরিবারের পক্ষ হ’তে ও তার উম্মতের পক্ষ হ’তে’।এরপর উক্ত দুম্বা দ্বারা কুরবানী করলেন’।(মিশকাত১৪৫৪)
নিজের পশু নিজেই কুরবানী করা সর্বোত্তম। নিজে যবেহ করতে অপারগ হলে অন্যের দ্বারা কুরবানী দুরস্ত আছে।কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়।যবেহ করার সময় কুরবানী পশু কেবলামুখী থাকতে হবে।আর কুরবানী করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, সীনার উপরিভাগ এবং রক্তনালীর মাঝামাঝি স্থানে যেন যবেহ করা হয়।যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলতে হবে। ইচ্ছাকৃত ভাবে বিসমিল্লাহ না বললে হালাল হবে না।আরো উল্লেখ্য যে, গলাতে চারটি রগ রয়েছে, তন্মধ্যে গলার সম্মূখভাগে দু’টি- খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এবং দু’পার্শ্বে দু’টি রক্তনালী। এ চারটির মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দুটি রক্তনালীর মধ্যে একটি অবশ্যই কাটতে হবে। অর্থাৎ চারটি রগ বা নালীর মধ্যে তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে।উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় ।
❖ পরিশেষে, মনে রাখতে হবে কুরবানী হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত ও আল্লাহ রাববুল ‘আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়।কুরবানীর উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়,শুধু মানুষের উপকার করা নয় বা শুধু সদকা (দান) নয়। কুরবানীর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের একটি মহান নিদর্শন তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা।করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা যেন কুরবানী করার সে তাউফিক আমাদের দেন।আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন