বিদায় হজ্জের ভাষণ
══➲══➲══➲ ✏ ইমরান বিন বদরী ≪
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম -আম্মা বা’দ।الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা মায়েদাহ,৩)
এই ভাষনে হাজার হাজার সাহাবা উপস্থিত ছিলেন আরাফার ময়দানে।এই আয়াত নাযিলের পর সমস্ত সাহাবীরা যখন খুশিতে আনন্দিত ঠিক তখনি আফজালুন্নাচ বাদাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু অশ্রুসজল চোখে বল্লেন এই আয়াত যে বিদায়ের আয়াত-আজ আমি বিদায়ের গন্ধ পাচ্ছি ইসলাম পরিপূর্ণ করা যে প্রিয় নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজের জন্য আসা তা সমাপ্ত করা আর সমাপ্ত করা মানে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া।
➲ হজ্বের ভাষণ:-
দশম হিজরির জিলহজ মাসে আল্লাহর রাসূল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গীসাথীসহ হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে গমন করেন এবং হজ্ব সম্পাদন করেন।এই ভাষণে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিলো।ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিলো। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। আজ লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে --'লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক'
لبيك اللهم لبيك ، لاشريك لك لبيك ، إن الحمد والنعمة لك والملك لاشريك
দীর্ঘ ২৩ বছর কঠিন পরিশ্রম,সংগ্রাম,অপরিসীম কুরবানি ও ত্যাগ স্বীকার করে আজ তা পূর্ণতায় উপনীত।ইসলামের ইতিহাসে তা-ই 'হাজ্জাতুল বিদা' বা 'বিদায় হজ' নামে পরিচিত।এ ছাড়া এই ভাষণকে 'হাজ্জাতুল বালাগ' ও 'হাজ্জাতুত তামাম' বা পূর্ণতার হজ নামেও অভিহিত করা হয়। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত,বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া এ ভাষণ ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিয়ামত অবধি বিপদসংকুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। এ ভাষণ ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি।মুসলিম উম্মাহ আজ আরাফাতের ময়দানে সমবেত। আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব মানুষের সামনে দাঁড়ালেন।আল্লাহর রাসূল ﷺ প্রথমে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা করলেন।এরপর তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করলেন-
➲ হে মুসলিম উম্মাহ আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন। আমার মনে হচ্ছে এর পরে হজ্বে যোগ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না।
➲ আমি তোমদের কাছে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তা দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখলে তোমরা সামান্যও পথভ্রষ্ট হবে না।তা হচ্ছে كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’(হাদীস/আদর্শ)। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
➲ মূর্খ যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধ বিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ মথিত হয়ে গেল। (সহীহ বুখারী)
➲ একজনের অপরাধের জন্য অন্যকে দন্ড দেয়া যাবে না। অতএব, পিতার অপরাধের কারণে সন্তান আর সন্তানের অপরাধের কারণে পিতাকে দায়ী করা চলবে না। (তিরমিযী)
➲ সমস্ত রক্ত-প্রতিশোধ আজ থেকে রহিত।আমি সর্বপ্রথম ঘোষণা করছি, আমার গোত্রের প্রাপ্য সকল সুদ ও সকল প্রকার রক্তের দাবী আজ থেকে রহিত হয়ে গেল। (সহীহ মুসলিম)
➲ মনে রেখো, তোমাদের সবাইকেই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। তাঁর নিকট সকল কিছুর জবাবদিহি করতে হবে। সাবধান! তোমরা যেন আমার পরে ধর্মভ্রষ্ট হয়ে যেও না। কাফের হয়ে পরস্পরে রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। (সহীহ বুখারী)
➲ দেখো, আজকের এই হজ্ব দিবস যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ, মক্কার এই হারাম (বাইতুল হারাম) যেমন পবিত্র- প্রত্যেক মুসলমানের ধন সম্পদ,মান-সম্ভ্রম এবং প্রত্যেক মুসলমানের রক্তবিন্দু তেমন তোমাদের কাছে মহান, তেমন পবিত্র। পূর্বোক্ত বিষয়গুলোর অবমাননা করা যেমন তোমরা হারাম মনে করো, ঠিক তেমনি কোনো মুসলমানের সম্পত্তি, সম্মান ও প্রাণের ক্ষতি করা তোমাদের জন্য হারাম। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
➲ আজ শয়তান নিরাশ হয়েছে, সে আর কখনো তোমাদের কাছে পাত্তা পাবে না। কিন্তু সাবধান! অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলে মনে করো, অথচ শয়তান সে বিষয় দিয়েই তোমাদের সর্বনাশ করে থাকে। ঐ বিষয়গুলো সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকবে। (ইবনে মাজাহ)
➲ নারীদের ব্যাপারে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, তাদের প্রতি কখনো নির্মম হয়ো না। এক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই কালাম দ্বারা তোমাদের দাম্পত্য স্বত্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনে রেখো, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন দাবী ও অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমন দাবী ও অধিকার আছে। তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করবে। মনে রেখো, এই অবলাদের বল তোমরাই, এদের একমাত্র সহায় তোমরাই। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
➲ যারা উপস্থিত আছো, তারা অনুপস্থিতদেরকে আমার এই সকল পয়গাম পৌছে দেবে। হতে পারে, উপস্থিত কিছু লোক থেকে অনুপস্থিত কিছু লোক এর দ্বারা বেশী লাভবান হবে। (সহীহ বুখারী)
➲ সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই অতিরিক্ততার ফলে তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। (ইবনে মাজাহ)
➲ যদি কোনো হাবশী কৃতদাসকেও তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়,আর সে যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনা করতে থাকে তবে তোমরা সর্বোতভাবে তার আদেশ মেনে চলতে থাকবে। তার অবাধ্য হবে না। (সহীহ মুসলিম)
➲ যে ব্যক্তি নিজের বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে পরিচয় দেয়,তার উপর আল্লাহ পাকের, ফেরেশতাদের ও সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। (আবু দাউদ)
➲ সাবধান! দাস দাসীদের নির্যাতন করো না। কোনো মানুষের উপর অত্যাচার করো না।শিরক করো না,অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করো না,ব্যাভিচার করো না।জেনে রাখো,এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই।
#এরপর তিনি শরীয়তের অনেক মৌলিক বিধান বিবৃত করেন।ভাষণ শেষ তিনি বললেন,‘হে মহান প্রভু! আমি কি তোমার দ্বীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন,নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখন তিনি আবার বললেন,হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছে আমি আপনার দ্বীন লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। তখন নূর নবীর ﷺ আলোকদীপ্ত চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এ সময় পবিত্র কুরআনে কারীমের শেষ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। শেষ বারের মত হজ্ব করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন সেই ইয়াছরেবে (মদিনা) যা রাহমাতুল্লীল আলামীন যাওয়ার পূর্বে ছিল অন্ধকার এক নিমজ্জিত জনপদ।আজ তা হয়ে গেল মদিনা যে মদিনাতে আছে জান্নাতের এক টুকরা অংশ।আজ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফিরে যেতে হবে সেই চৌদ্দ শত বছর আগে। জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে বিদায় হজের ভাষণের সুমহান আদর্শে।
◉সম্মানিত বন্ধুরা "আসুন ইসলামের রাহে উম্মতে মুহাম্মদীর মুক্তির কথা বলি "আল্লাহপাক যেন আমাদের সবাইকে সে তৌফিক দান করুন। আমিন,সুম্মা আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন